কক্সবাজার থেকে সাগর পথে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের মামলায় ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছে র্যাব-১২।
মঙ্গলবার টাঙ্গাইলের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।
অভিযুক্তরা হলেন- মো. রুহুল আমিন ওরফে রুবেল, মো. শহিদুল ইসলাম, মো. আবু মোহাম্মদ, মো. পিন্টু আলী, মো. আনোয়ার ইসলাম, মো. মাহমুদল হক, মো. হামিদুল হক ওরফে কামাল ডাকাত, ইউনুছ আলী, মো. শওকত আলী, বাপ্পী বাকুইল্ল্যাহ ওরফে শফি, মো. আব্দুল করিম, মনসুর, মো. আবুল কালাম, আবদুল গফুর, বেলাল, এবং তদন্তে প্রাপ্ত পলাতক আসামি মো সুরুত আলম, মো. আকবর ওরফে ছৈয়দ আকবর এবং সাবু।
র্যাব জানায়, ২০১৫ সালের ১২ মার্চ টাঙ্গালের র্যাব-১২ এর কাছে অভিযোগ করেন ফজলু ও আনিছুর রহমান নামের দুই ব্যক্তি। অভিযোগে তারা বলেন, টাঙ্গাইলের রুবেল, শহিদুল, শওকত, ইউসুফ, চট্রগ্রামের আবু মোহাম্মদ, পিন্টু এবং কক্সবাজারের আনোয়ার, মাহমুদুল ও হামিদুলের সহায়তায় সকল আসামিরা তাদের দুই সন্তান জাহাঙ্গীর ও সোহেলকে মালয়েশিয়া পাচার করে দিয়েছেন। আসামিরা পরষ্পর যোগসাজসে অবৈধভাবে সাগরপথে মাছ ধরার ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় পাচার করে তাদের সন্তানদের কান্নার আর্তনাদ শুনিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে দুই লাখ ৩০ হাজার টাকা করে দাবি করছে। টাকা পরিশোধ না করলে তাদেরকে সাগরে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে।
অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে গত ২২ মার্চ অভিযান চালিয়ে টাঙ্গাইল থেকে দুইজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গ্রেপ্তারকৃতরা চট্রগ্রামে থাকা তাদের অন্য সহযোগিদের নাম প্রকাশ করে। আভিযানিক কর্মকর্তা মুহম্মদ মহিউদ্দিন ফারুকী আসামিদের নিয়ে টাঙ্গাইল থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছে তিনজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের দেয়া তথ্য মতে সাগর পথে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে কক্সবাজার পাঠানো ১২ জন ভুক্তভুগীকে উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করে র্যাব। পরে কক্সবাজারের উখিয়া থানার খুনিয়া পালং থেকে দুইজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ১২ জন ভুক্তভুগীকে উদ্ধার করা হয়। পরে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের অপর দুই সহযোগিকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব নেয় র্যাব-১২। এরপর তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী মামলার তদন্তভার নিয়ে তদন্তকালে নয়জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেন। মামলার তদন্তে এ পর্যন্ত ১৮ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তদন্তে তিনজন আসামির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলেও তথ্য প্রমাণ ও সঠিক নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
মামলার তদন্তকালে জানা যায়, বাংলাদেশে ও মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তারকৃত এবং পলাতক আসামিরা জড়িত। আসামিরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সাধারণ নিরীহ লোককে বিনা পয়সায় মালয়েশিয়ায় পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দালালের মাধ্যমে লোক সংগ্রহ করে। টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রীদের প্রথমে চট্টগ্রাম আনে। পরে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের টেকনাফে নিয়ে আসে। টেকনাফ থেকে ধাপে ধাপে তাদের মালয়েশিয়াগামী মাছ ধরার ট্রলারে উঠায়। ট্রলারের ওঠানোর পর থেকেই যাত্রীদের বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে। নির্যাতন ও অনাহারে যাত্রীদের মধ্যে কোনো যাত্রী গুরুতর অসুস্থ বা মারা গেলে তাদের সাগরে ছুড়ে ফেলা হয়। মায়ানমার, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জল সীমায় ট্রলার পরিবর্তন করে যাত্রী হস্তান্তর করা হয়। এভাবে মালয়েশিয়া সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছার আগেই জীবিত সকল যাত্রী ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
গ্রেপ্তারকৃত ও পলাতক আসামিরা প্রতিনিয়ত মালয়েশিয়ায় যাতায়াত করে সমুদ্র পথে পাঠানো যাত্রীদের মালয়েশিয়ায় গ্রহণ করেন। যাত্রীদের গ্রহণ করার পর মালয়েশিয়ায় থাকা জলদস্যুদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলে বাংলাদেশ থেকে যাত্রীদের অঞ্চলের টর্চার সেলে নিয়ে যায়। সেখানে বাংলাদেশে থাকা ভুক্তভুগীদের আত্মীয় স্বজনদের ফোন করে, সোশ্যাল মিডিয়ার মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যপসে, ভাইবার বা ইমো মাধ্যমে ভিডিও কল করে ভুক্তভুগীদের মারধরের ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে। বাংলাদেশে থাকা গ্রেপ্তারকৃত ও পলাতক আসামিদের মাধ্যমে টাকা আদায় করতো।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ সুপার মুহম্মদ মহিউদ্দিন ফারুকী ঢাককাটাইমসকে বলেন, আসামিরা দেশের বিভিন্নস্থান থেকে মানুষ সংগ্রহ করত। পরে তাদেরকে অবৈধভাবে মাছের ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় পাঠাত। সেখানে তাদেরকে মারধোর করে জিম্মি করে টাকা আদায় করত।